আগামী ১৭ জুলাই আরবি ক্যালেন্ডারে ১০ মুহররম। আরবিতে দশ সংখ্যাকে “আশারাতুন বা আশারাহ” বলা হয়। এই শব্দ থেকেই ১০ই মুহররমকে আশুরার দিন বলা হয়। মুহররমের ১০ তারিখে পৃথিবীর ইতিহাসে বেশ কিছু বড় বড় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এজন্য রাসুল সা.ও এই দিনটিকে অত্যন্ত ফজিলতের বলে ঘোষণা করেছেন। শুধু যে আশুরার দিন ফজিলতের তা নয়। বরং আরবি মাসগুলোর মধ্যে ৪টি মাসকে “আসহুরুল হুরুম বা সম্মানিত মাস” বলা হয়। এরমধ্যে একটি হচ্ছে মুহররম মাস। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘রমজানের পর আল্লাহর নিকট মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।’ (সহিহ মুসলিম)
হযরত আলি (রা.)-কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমজানের পর আর কোনো মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন হযরত রাসুলুল্লাহ সা.’র কাছে জনৈক সাহাবি করেছিলেন, তখন আমি তার খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে হযরত রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, ‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রাখো। কারণ এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’ (জামে তিরমিজি)
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘কুরাইশরা জাহেলি যুগে আশুরার দিন রোজা রাখত। অতঃপর যখন রমজানের রোজা ফরজ হয়, তখন রাসুল সা. বলেন, যার ইচ্ছা আশুরার রোজা রাখবে, আর যার ইচ্ছা রোজা রাখবে না। (সহিহ মুসলিম) ইহুদিরাও আশুরার দিন রোজা রাখত। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) এ আমলকে ইহুদিদের থেকে আলাদা করার জন্য ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ বা ১১ তারিখেও রোজা পালন করতে উৎসাহ দিয়েছেন। অর্থাৎ আশুরার আগের দিন বা পরের দিন মোট দুটি রোজা রাখা সুন্নত।
অপর দিকে আশুরার দিনের ইতিহাস তালাশ করলে যে সব তথ্য পাওয়া যায় তা হচ্ছে;
১. আল্লাহ পাক এই বিশাল ভূখণ্ড, আকাশ, জমিন, পাহাড়-পর্বত সব কিছু আশুরার দিনে সৃষ্টি করেছেন।
২. আদম (আ.) ও হাওয়া আ.কেও এই দিনে সৃষ্টি করেছেন।
৩. হযরত নূহ আ. মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে যখন অবতরণ করেন সেই দিনটি ছিল ১০ মুহররম।
৪. হযরত ইবরাহিম (আ.) নমরুদের প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড থেকে যেদিন মুক্তিলাভ করেছিলেন সেটিও ছিল ১০ মুহররম।
৫. হযরত আইয়ুব আ. দীর্ঘ ১৮ বছর রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এরপর আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তিলাভ করেন। যেদিন তিনি পরিপূর্ণ মুক্তি লাভ করেন সেই দিনটি ছিল আশুরার দিন।
৬. হযরত সুলাইমান আ. যেমন ছিলেন নবী তেমনি ছিলেন প্রভাবশালী বাদশা। দেও দানব, পশু-পাখী এমনকি বাতাস পর্যন্ত তাঁর নির্দেশ পালন করত। আল্লাহ পাক তাকে পৃথিবীর রাজত্ব দান ১০ মুহররম।
৭. হযরত ইউনুস আ. দীর্ঘ ৪০ দিন দজলা নদীতে মাছের পেটে অবস্থান করে ছিলেন। এরপর আল্লাহ পাক তাকে জীবিত অবস্থায় মাছের পেট থেকে ১০ মুহররম উদ্ধার করেন।
৮. হযরত মূসা আ. ও তার জাতিকে আল্লাহ পাক আশুরার দিনে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেন। যার কারণে ইয়াহুদীরা এই দিনে রোজা রাখে। আর হাদিসে এর প্রতিই রাসুল সা. ইঙ্গিত করেছেন।
৯. হযরত ঈসা আ. ১০ই মুহররম জন্মগ্রহণ করেন এবং এই একই তারিখে জীবতাবস্থায় আসমানে উত্তোলন করা হয়। ১০. হযরত ইদ্রিস আ.কে আশুরার দিনে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়।
১১. হযরত দাউদ আ.কে এই দিনে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হয়।
১২. হযরত আদম আ.কে জান্নাতে প্রবেশ করানো, জান্নাত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ এবং গুনাহ মার্জনার পর তার সঙ্গে হাওয়া আ.কে মিলিয়ে দেয়া এর প্রত্যেকটি ১০ই মুহররম সংঘটিত হয়েছে।
১৩. হযরত ইয়াকুব আ. কর্তৃক হারানো পুত্র হযরত ইউসুফ আ. এর সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ লাভ করেন ১০ই মুহররম।
১৪. প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সা. মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনা শরিফে যে দিন পৌঁছেন সেই দিনটিও ছিল ১০ মুহররম।
১৫. বর্ণিত আছে, ১০ই মুহররম, শুক্রবার আছরের নামাযের পর কিয়ামত সংঘটিত হবে।
এভাবে অনুসন্ধান করলে ১০ই মুহররম ইতিহাসের অসংখ্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে আশুরার ফজিলত ঐতিহাসিক কারণে পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান প্রজন্ম মনে করে হযরত হোসাইন রা.’র শাহাদাতের কারণে এই দিনটি পালন করা হয়। এমনকি অনেক আলেমদেরকেও আশুরার আলোচনায় হযরত হোসাইন রা.’র শাহাদতের ঘটনার বাহিরে আর কোন আলোচনা করতে দেখা যায় না। বরং একটি মহল এই দিনটাকে খুবই মর্মান্তিক ভাবে পালন করতে দেখা যায়। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে এই সকল অপসংস্কৃতি ও অনৈসলামিক কার্যক্রম থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুক। আমীন!
Leave a Reply